চলন্ত ভালবাসা
ট্রেনের টিকেট কাটা হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে আন্তঃনগর তিস্তা এক্সপ্রেস এর ফার্স্ট ক্লাস এর দুটো টিকেট জোগাড় করতে পেরেছে রাশেদ। গন্তব্যস্থল জামালপুর। বাসায় ফিরেই টিকেট দুটো কিয়ান এর হাতে ধরিয়ে দেয় ও। -এবার খুশি তো? -অনেক খুশি। এই না হলে আমার লক্ষ্মী জামাই।
কিয়ান এর খুশি দেখে কে। বেশি খুশি হলে বাচ্চাদের মতো চেহারা হয় ওর। কি করবে খুঁজে পায় না। হেসে ওর গাল দুটো টেনে দেয় রাশেদ।
জামালপুর রাশেদের পৈত্রিক নিবাস। যদিও বাবা মা কেওই বেঁচে নেই ওর। বাড়িতেও কেও থাকে না তেমন। আগে বাবা চাচাদের একসাথে যৌথ পরিবার ছিল। সেই যৌথ পরিবারেই ওর বড় হওয়া। পড়াশোনা সব সেই মফস্বল শহরেই।
কিয়ান এর সাথে বিয়ের তিন মাস হতে চলল । শ্বশুরবাড়ি দেখবে বলে কিয়ান মাথা খারাপ করে দেবার জোগাড়। কেও নেই,কি হবে ওখানে যেয়ে এসব বলেও কিছুতেই তাকে নিরস্ত করা যায় না। সে দেখবেই।
কুয়াশাঘেরা এক সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে এলো রাশেদ আর কিয়ান। কিয়ান কোনদিন ট্রেন এ উঠেনি। ওর খুব শখ ট্রেন এ চড়ার।
কিয়ান খুব সুন্দর করে সেজেছে। হাতভর্তি চুড়ি। কপালে টিপ। চোখে কাজল। মুখে হালকা মেকআপ। এমনিতেই যথেষ্ট সুন্দরী ও। বড়লোকের মেয়ে বলে কথা! সুন্দর হওয়ার জন্য আলাদা মেকআপ এর প্রয়োজন হয় না। রাশেদ ঠাট্টার ছলে বলে
-এত সুন্দর কেন তুমি? তোমার সাথে তো আমাকে মানায় না। মানুষ বলবে আকাশের পরী টুপ করে পরে আমার কাছে এসে পরেছে। কিয়ান আলতো ঘুসি দেয় রাশেদের বুকে। -সারাক্ষণ খালি বাঁদরামি। ভালো কিছু নাই তোমার মুখে? -ভালোই তো বললাম। কিয়ান অর্থই হল অপ্সরা। অপ্সরাকে অপ্সরাই তো বলবো নাকি? নিজের বউয়ের প্রশংসা করাও কি অপরাধ? - হ্যা অপরাধ। সবসময় রোম্যান্টিক গল্প লিখো রুপা কে নিয়ে আর আমাকে দেখলেই তোমার বাঁদরামি শুরু হয়? -ইয়াল্লা। এ কি বল? বউ থাকতে পরনারীর দিকে তাকাবো কোন দুঃখে? -ওরে আমার চরিত্রবান স্বামী রে... তোমার দুঃখ কি আর আমারে বল... নিজেই জানো কি দুঃখ তোমার। - এটা তোমার ভুল ধারণা। কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ রাখা ঠিক না। -যাও রাখলাম না সন্দেহ, বলেই হিহিহি করে হাসতে শুরু করে কিয়ান। রাশেদ ও হাসে ওর সাথে। ট্রেনের জানালা দিয়ে শীতের সকালের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে যায় কিয়ান। মাঝেমাঝে এটা কি ওটা কি জিজ্ঞেস করতে থাকে। একসময় বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে রাশেদ এর কাঁধে হেলান দেয়। -আচ্ছা বলতো আমি কেন জামালপুর যাচ্ছি? -কেন আবার? তুমিই না শ্বশুরবাড়ি দেখার জন্য পাগল! -তা তো দেখবোই। সাথে আরেকটা কাজও করবো। রাশেদ অবাক হয়ে বলে- কি কাজ? -তোমাকে তো বলবো না। -ওমা তো কাকে বলবা? -বলতে পারি,এক শর্তে। রাগ করতে পারবা না। -কি এমন কাজ যে শুনলে আমি রাগ করবো? -আগে বল রাগ করবা না? -আচ্ছা, করবো না। -রুদমিলা আপুর সাথে দেখাও করবো।
রাশেদ চমকে তাকায় কিয়ান এর দিকে। কিয়ান মিটিমিটি হাসছে। যে নাম সে দীর্ঘদিন শুনেনি,যে নাম সে দীর্ঘদিন বলেনি, যে নাম রাশেদ অনেকদিন কখনো কোথাও লিখেনি সে নাম কিয়ান কি করে জানে।
-কি বেশি অবাক হলে? - হ্যা কিছুটা। -রাগ করোনি তো আমার উপর? - আমি কখনোই তোমার উপর রাগ করি না। -জিজ্ঞেস করলে না কীভাবে জানলাম? -কীভাবে? -আমার এক দূরসম্পর্কের কাজিন উনার ব্যাচমেট ছিল ভার্সিটির। আমাদের বিয়েতেও এসেছিলো সে কাজিন। তোমাকে নাকি আগে থেকেই চিনে। - ও আচ্ছা। কিছুটা ধাতস্থ হয় রাশেদ। - আমাকে চিনে আবার রুদমিলার ও ব্যাচমেট তাহলে তো আরও অনেক কিছুই জানার কথা। কিন্তু তোমাকে কে বলল রুদমিলা বাড়িতে? ওর তো শ্বশুরবাড়ি থাকার কথা! জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় রাশেদ কিয়ান এর দিকে। -তুমি সত্যিই জানো না কিছু? -না, কি জানবো? -ওনার ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক আগেই। একমাস সংসার করেছিলেন। এরপর আর বিয়ে করেননি। স্বামীর সাথে বনিবনা হয়নি।
এতোটা চমক রাশেদ আশা করেনি। এসবের কিছুই সে জানেনা। রুদমিলার বিয়ে যখন ঠিকঠাক তখন সে ঢাকা এসে পরে। এরপর আর ওদিকে পা মাড়ায়নি।
- নাও এবার বল... তাড়া দেয় কিয়ান ... -কি বলবো? -তোমাদের প্রেমকাহিনী আবার কি... -ওসব কিছু না। অল্প বয়সে সবারই হয় টুকটাক। তোমারও আছে। -আমার টা তো জানোই। ভার্সিটি তে থাকতে এক কবির প্রেমে পড়েছিলাম। আর এক বড় ভাইয়ার উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম। এক ছেলে কিছুদিন ঘুরেছিলো কলেজে থাকতে। এইতো। সবই জানো তুমি। তোমারটা বল এখন। -তুমিও তো জানোই। তোমার কাজিন বলে নাই? -নাহ। আমি কিচ্ছু শুনিনি। তোমারটা আরেকজনের কাছে শুনবো কেন? তুমি বলবা। - আচ্ছা বলতেছি। বাদাম খাবা? - হু খাবো। বাদাম আলাকে ডাক দেয় রাশেদ। ট্রেন ততোক্ষণে গফরগাঁও এসে পড়েছে। বাইরে ঝকঝকে রোদ। কুয়াশার লেশমাত্র নেই। ট্রেন এ বসেও দূর লোকালয়ের কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়। বাদাম ছিলতে ছিলতে জীবনের প্রথম ভালোলাগা ভালোবাসার কথা মনে পরে যায়। রাশেদ বলা শুরু করে...
তখন সবে কলেজ পাশ করে ভার্সিটি তে উঠেছি। আগে থেকেই টুকটাক রাজনীতি করতাম। ভার্সিটি তে উঠে আরও স্বাধীনতা পেলাম। নতুন ফ্রেন্ডসার্কেল,
-তারপর কি হল? কিয়ান এর চোখেমুখে উত্তেজনা...
রাশেদ বলতে থাকে... আমি ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আশেপাশের মানুষজন আমাকে ভুলতে দিলো না। ভিসি বিষয়টি জানতে পেরে আমাদের দুজনকেই পরের দিন ডেকে পাঠালেন অফিসে। রুদমিলাকে দ্বিতীয় বারের মতো ভালো করে দেখলাম। শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র চেহারা,গতদিনের মারমুখী ভঙ্গীর সাথে মিল খুঁজে পাওয়া দুরহ। বরঞ্চ কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত দেখলাম ওকে। ভিসি বললেন- তিনি ঘটনা তদন্ত করেছেন। যে প্রকৃত অপরাধী সে নিজে এসে ক্ষমা চেয়ে গেছে উনার কাছে। রুদমিলার অপ্রত্যাশিত ব্যাবহার এর জন্য তিনি ওকে তিরস্কার করলেন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কিছু না হয় সে ব্যাপারে দুজনকেই সতর্ক করে দিলেন।
কিয়ান থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো – ভিসির রুমে রুদমিলা আপু কিছু বলেনি?
রাশেদ তৎক্ষণাৎ উত্তর না দিয়ে বলে – আসছি সে কথায়। ঝালমুড়ি খাবা?
- না, তুমি কন্টিনিও করো...
রাশেদ কন্টিনিও করে - তুমি তো জানোই তোমার শ্বশুর স্কুলটিচার ছিলেন। শক্ত ধাঁচের মানুষ। আমাকেও সেভাবে গড়েপিটে মানুষ করেছেন। রাজনীতি করতাম বলে পাড়ায় আমার একটা সুনাম যেমন ছিল দুর্নামও তেমন ছিল। পরে পরে মার খাওয়াটা আমার স্বভাবে ছিল না। বাবা বলতেন- কেও গায়ে হাত তুললে বসে থেকো না, আগে মারো বিচার শালিশ পরের ব্যাপার। মারামারি কম করিনি সে সময়টায়। কিন্তু একটা মেয়ে বলে কথা। তাও আবার ভুল বোঝাবোঝি। ভিতরে ভিতরে সত্যিই আমি জ্বলছিলাম অনেক। কিছু করার ছিল না একদমই।
ভিসির রুম থেকে বেড়িয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম রুদমিলার জন্য। ও আসলো। চোখ তুলে তাকাতে পারছিলো না আমার দিকে। সোজা পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল – সরি। আমি বললাম শুধু সরি? - আসলে রেগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। রিয়েলি ভেরি সরি। আমি চাইছিলাম ওকে একটু কথা দিয়ে হার্ট করতে। তাই বললাম - এত দেমাগ কিসের? রুপের দেমাগ? বেশি সুন্দরী মনে করেন নিজেকে? ও কোন কথা বলতে পারলো না। নীরবে নিচে তাকিয়ে রইলো।
-আমাকে চিনেন? এই রাশেদ না চাইলে যে আপনার বিয়ে হবে না জানেন? কারো বুকের পাটায় এত সাহস নেই যে রাশেদ না চাইলে এই এলাকা থেকে কোন মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। কথাটা মাথায় রাখবেন আর সাবধানে জুতা স্যান্ডেল ছুঁড়াছুঁড়ি করবেন।
![]() |
valobasher golpo |
-যেভাবে হয়, অনেকটা বাংলা সিনেমার মতো। রাশেদ বলে যায়... মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে আমার পরে কিছুটা অনুশোচনা হয়। কিন্তু রুদমিলা এর পর থেকে আর ক্লাসে আসতো না। কীভাবে ওকে কি বলি। আমার অনুশোচনা ভালোলাগায় রূপান্তরিত হল। শেষপর্যন্ত আমার এক বান্ধবীর মাধ্যমে ওর ঠিকানা পাই। আমাদের পাশের এলাকায় বাসা। ওর বাসার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আগেই খবর নিয়েছিলাম ওর পরিবার সম্বন্ধে। অনেক রক্ষণশীল ওরা। মেয়েরা সবসময়ই পর্দার মধ্যে থাকতো। তাই সরাসরি বাসায় যাওয়ার বোকামি করিনি। ওর বাসায় কি মনে করে... তবে রুদমিলা বের হতো প্রতিদিন সকালে আর বিকেলে। ওর ছোট বোনকে স্কুলে দিয়ে আসতো আর আনতে যেতো। ওর পিছু পিছু যেতাম আসতাম,কিন্তু কথা বলার সুযোগ পেতাম না। ও প্রথমদিন থেকেই আমাকে চিনতে পেরেছিলো। কিন্তু না চেনার ভান করে থাকতো। একদিন বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি ওদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে। বিকেল হলেও সন্ধ্যার ঘনঘটা চারদিকে। আবছা আলোআঁধারি তে ওদের বাসার দিকে নিজর রাখছি। হঠাৎ ওপরে তাকিয়ে দেখি রুদমিলা ছাদে যেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমি সোজা চলে গেলাম ওদের ছাদে। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ও। আশেপাশে কোন জনমানুষ নেই। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ছাদে ও একা একটা মেয়ে ভিজছে আর আমি। সোজা আমি ওর কাছে যেয়ে ওর হাত ধরে ফেলি। ওর হাতে দীর্ঘ ২২ পৃষ্ঠার একটা চিঠি দিয়ে আমি চলে আসি আবার। ঐ চিঠি আমি রাতের পর রাত জেগে লিখেছি। অনেক ছেলেমানুষি কথাবার্তা ছিল। বেশ হাস্যকর ব্যাপার। চিঠির শেষ লাইন ছিল- চিঠির জবাব না পেলে তোমার বাসার নিচে দাঁড়ানো আমি কখনোই ছাড়ছি না। চিঠি দেওয়ার সময় খেয়াল করিনি যে বৃষ্টির পানিতে চিঠির কি অবস্থা হবে। পরে জেনেছিলাম আমার বোকামির জন্য ২২ পৃষ্ঠার চিঠির জবাব দিতে রুদমিলার ২১ দিন লেগেছিলো- রোদে শুকিয়ে,ইস্ত্রি করে,আগুনে দিয়ে চিঠির পাঠোদ্ধার করতে করতে ততদিনে চিঠির আশা ছেড়ে আমি দেবদাস পুরোপুরি।
হিহিহিহি... হাসিতে ফেটে পরে কিয়ান। তা কি জবাব দিয়েছিলো চিঠির?
- ওর চিঠি এতো বড় ছিল না। মাত্র ৪ পৃষ্ঠার ছিল। ওর এক ক্লাসমেট এর মাধ্যমে চিঠি পৌঁছায় আমার কাছে। চিঠির বক্তব্য ছিল- ওদের পরিবারে মেয়েদের প্রেম করা একদম নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাকে ওর ভালো লেগেছে। ওকে সারাজীবনের জন্য পেতে হলে ওকে বিয়ে করতে হবে তাও সবার সম্মতিতে।
এই হল আমার প্রেমকাহিনী। কোন প্রশ্ন?
- বিয়ে কেন করোনি তা অনুমান করতে পারি,বেকার ছিলা। কিন্তু এরপরে আর যোগাযোগ হয়নি?
-হ্যা, তোমার অনুমান সঠিক। আমি বিয়ে করতে চাইতাম পালিয়ে যেটা সে কখনোই চাইতো না। আর যোগাযোগ বলতে সেই চিঠি। সারারাত জেগে ১০/১২ পৃষ্ঠার চিঠি লিখতাম। চিঠির জবাব পেতাম ১ দিন পর খুব বেশি হলে ৩ পৃষ্ঠার। টি এন্ড টি ফোন এ কথা বলতাম মাঝেমাঝে ওদের বাসায় কেও না থাকলে। বিশ্বাস করবা কিনা জানি না যে পরিমাণ চিঠি আমি লিখেছি সেই চিঠি যদি কেও সংগ্রহ করে রাখে তাহলে একটা জাদুঘর দেওয়া যাবে প্রেমপত্রের। “রাশেদ’স প্রেমপত্র সংগ্রহশালা” হাসতে থাকে রাশেদ। রাশেদ এর হাসি খুব সুন্দর। সে হাসি নয়ন ভরে দেখে কিয়ান। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। এতো সুন্দর মানুষ এর হাসি হয় কি করে। রুদমিলা হতে ইচ্ছা হয় কিয়ান এর। একদিনের জন্য হলেও। ২২ পাতার প্রেমপত্র পাওয়ার জন্য হলেও। গল্প করতে করতে ট্রেন যে কখন গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছায় দুজনের কেওই খেয়াল করে না। ব্যাগ গুছাতে গুছাতে কিয়ান প্রশ্ন করে -আচ্ছা রুপা নামটা কি তোমার দেওয়া না রুদমিলা আপুরই ডাকনাম?
রাশেদ মুচকি হাসে। অপ্সরাদের হিংসে করতে নেই।