আমাদের ইচ্ছা
লাঞ্চ আওয়ার চলছে । সঙ্গে আনা লাঞ্চ বক্সটা মাত্র খুলেছি এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো । স্ক্রীনে মিতু’র হাসিমাখা মুখ । বাটিটা একপাশে সরিয়ে মিতুকে বাসা থেকে এক টাচে কানের পাশে নিয়ে এলাম , “ হ্যালো ” ।
কানে কানে ফিসফিসিয়েই জবাব এলো , “ স্যারের কি খাওয়া হইছে ? ”
“ না সোনা , মাত্রই বসছিলাম ” ।
“ তুমি অফিসে বইসা আমারে সোনা ডাকতেছ , কেও যদি শুইনা ফেলে ? ”
“ শুনলে শুনবে । কিন্তু তুমি এতো আস্তে কথা বলতেছ কেন ? ”
“ আরে , ইচ্ছা মাত্র ঘুমাইল । আর তোমার মেয়ের স্বভাব তো তুমি জানই , একটু জোরে আওয়াজ হইলেই ঘুম উধাও...”
“ বুঝছি বাবা...এখন রাখি ? দেরী হয়ে গেলে তোমার দেয়া খাবারগুলা কান্না শুরু করবে...”
“ অত কিছু বুঝিনা । শোন , একটা কথা বলি ? ”
“ আচ্ছা , ম্যাডাম । বলেন ” ।
অভিমানী কণ্ঠে মিতু বলল , “ জানো , আজকে ইচ্ছা’রে জিজ্ঞেস করলাম বলতো আম্মু তুমি কার কলিজার টুকরা ? আর অমনি মেয়েটা বলে কিনা বাবাই , বাবাই...আমি বুঝি ওর কেও না...? ”
“ ও এই কথা ? হাহাহাহাহা...”
আমার হাসি শুনে অভিমানী কণ্ঠটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো ,
“ এই , মুখ ভেচকায়া হাসবানা বললাম , আজকে বাসায় আইসাই তুমি ওরে বুঝায়া বলবা সে আম্মুরও বুকের মানিক , কি বলবানা...? ”
“ আচ্ছা পাগলী , আচ্ছা । বাসায় এসেই বলে দিব যে ছোট্ট সোনা টা বাবাই , আম্মু দুই জনেরই বুকের মানিক । খুশী ? ”
“ হুম...জানো আজকে কি হইছে ? ইচ্ছা’রে কোলে করে বারান্দায় গেছি । পাশের আমগাছটার উপর একটা কাক বইসা ছিল । আর ইচ্ছা কাকটারে দেইখাই বলে , তা তা তা...এইটুকুন মেয়ে , ও কাক কেমনে চিনল ? আমি তো দেখাইনাই কোনদিন । তুমি যে বিকেলে ওরে বাইরে নিয়া যাও তখন দেখাইছ ? ”
“ হুম , দেখাইছি তো...”
দেড় বছরের ইচ্ছা কে ঘাড়ে বসিয়ে প্রতি বৃহস্পতি আর শুক্রবারে বৈকালিক ভ্রমণে বেড়োনোটা গত তিন মাস ধরে একটা রুটিনের পর্যায়ে চলে গেছে । প্রথম প্রথম মিতু মানা করতো । বলতো , “ এতো ছোট্ট মেয়ে , কই সারাদিন মায়ের কোলে লুকিয়ে থাকবে , তা না , উনি মেয়েরে বিশ্ব দেখাবেন...” । তবুও আমি নিয়ম করে আমার আম্মুটাকে নিয়ে বের হতাম , কোনও ভুল হতোনা । আর এখন তো ভুল হওয়ার কোনও অবকাশই নেই । রোজ দুপুরে মেয়েটা নেয়ে খেয়ে মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমোয় ঠিকই , কিন্তু বিকেল হতেই কিভাবে যেন ঘুম ভেঙ্গে যায় তার । ঘুম থেকে উঠে ফোলা ফোলা দু চোখ কচলাতে কচলাতে গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে মিতু’র আঁচল ধরে টানাটানি শুরু করে । তারপর আর কি ? নাশতা বানানো বন্ধ করে তার হাত মুখ ধুইয়ে ছোট ছোট চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে দুই গালে আর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বাবাইয়ের ঘাড়ে তুলে দিলে তবেই পুতুল খানা শান্ত আর ম্যাডামেরও শান্তি । উহুহু...ম্যাডাম
তারপর বাবা আর মেয়েতে মিলে আশেপাশের সমস্ত অলিগলি চষে বেড়াই । বড় রাস্তায় যাওয়া নিষেধ কিনা...রাস্তা দিয়ে গাড়ি যায় , আমি মেয়েকে দেখিয়ে বলি , “ আম্মু দেখ দেখ গাড়ি যায় । কেমন আওয়াজ করে পাজিটা ? পাজি গাড়িটা বুউউম করে ? বুউউম করে দুষ্টুটা ? আমার আম্মুটারে ভয় দেখায় ? হুহ...চলো আমরাও বুউউম করি ? বুউউউম...” । ইচ্ছা তখন ছোট ছোট তুলতুলে দুই হাতে আমার চশমাটাকে খামচে ধরে স্টিয়ারিং বানিয়ে বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে মুখটা আমার মাথায় ঠেকিয়ে একনাগাড়ে বুউউউউউম করে আওয়াজ তোলে ।
ইচ্ছা কুকুরও চেনে । কুকুরের ঘেও ঘেও ডাকে তার ভীষণ ভয় । কোনও কোনও দিন রাস্তায় ডাস্টবিনের পাশে কুকুর চোখে পড়ে । আমার চোখে আগে পড়লে আমি রাস্তা বদল করে ফেলি । কিন্তু ইচ্ছা আগে দেখে ফেললেই হয়েছে...বাবাই , তুতুল...তুতুল..
এতে কি আর সে শান্ত হয় ? গুণগান চলতেই থাকে , “ সামনে পড়ে কেমনে ? মেয়েটা তার ছোট ছোট চোখ দিয়া ঠিকই তোমার আগে দেখতে পারে , আর তুমি গরুর মতন চোখ দুইটা নিয়াও দেখনা ? ” অকাট্য যুক্তি , এরপর আর কথা চলেনা । অগত্যা স্বীকার করে নিই ভুলটা আমারই ছিল । তবুও মহারাণী মাঝে মাঝেই ক্ষেপে উঠেন , “ মেয়েটা ভয় পাইলে তার কি...এই দেখো , এখনও মেয়েটা আমার ঘুমের মাঝে তুতুল...তুতুল বলে ফুঁপায়া উঠতেছে...আর যদি কোনওদিন খালি এমন হয় তবে...” । আর কোনদিন এমন হলে কি করবে তা অবশ্য সবসময় উহ্যই রাখে সে । আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচি ।
আর যেদিন মেয়েটার জন্য মন বেশী আনচান করে ঐদিন ফোন বাবাজীর আর বিশ্রাম নেই...বারবার ফোন দেয় । শেষবারের কথোপকথন হয় এমন ,
“ হ্যালো ”
“ এই তুমি ফোন ধরছ কেমনে ? ইচ্ছা তোমার ঘাড়ে না ? ”
“ হ্যা...”
“ নিশ্চয়ই আমার বাবুটারে এক হাতে ধইরা রাখছ ? পইড়া যদি যায় ? ”
“ আরে পাগলী পড়বেনা । দুই হাতেই ধরছি ”
“ তাইলে , ফোন ধরছ কেমনে ? ”
“ হেডফোনে কথা বলতেছি...”
“ কি !!!? তুমি কানে হেডফোন লাগায়া ঘুরতেছ ? এক্ষণ হেডফোন খুলো ”
“ আরে বাবা , ফোন কানে নিয়ে কথা বলতে পারবোনা , হেডফোনে কথা বলতে পারবোনা আর ম্যাডাম যে মিনিটে দশ বার করে ফোন দিয়ে বলবেন , আমার মেয়েটারে শক্ত কইরা ধরবা , ধরছ ?...মেয়েটার যে সর্দি লাগছে মনে আছে ? খালি ঘাড়ে নিয়ে ঘুরলেই হবে ? কতক্ষন ধইরা নাক মুছাওনা ?...এই সন্ধ্যা তো হয়ে গেলো , কোন পর্যন্ত আসছ ? আমার আম্মুটার না জানি কত্ত খিদা লাগছে...এগুলার জবাব কি ভূতে দিবে ? ”
“ আমি কিচ্ছু জানিনা । তুমি কেমনে জবাব দিবা তুমি জানো । এমনি এমনি কি বলি নাকি ? রাস্তায় কত্ত গাড়িঘোড়া । কানে হেডফোন লাগায়া রাখলে টের পাবা কোনদিক দিয়া গাড়ি আসে ? কিছু যদি হয়ে যায়...? ” এই পর্যন্ত বলেই পাগলীটার ফুঁপানি শুরু হয়ে যায় । এইদিনও তৎক্ষণাৎ বাসায় ফিরতে হয় । বাসায় ফিরে দেখি পাগলীটার গালে অশ্রু শুকিয়ে আছে । ইচ্ছা’কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে কোনও কথা না বলেই সে আমার বুকে মুখ গুজে । বিগত দুই ঘণ্টায় কোনও আশ্রয় না পাওয়ায় চোখের বাঁধ আবার ভাঙ্গে , ফোঁটা ফোঁটা জল জায়গা খোঁজে নেয় আপন মানুষটার বুকে । আমি কোনও কথা না বলে শুধু শক্ত করে মিতুকে জড়িয়ে রাখি ।
পরদিন সকালেই আবার সব ঠিক । মিতু ইচ্ছা’কে খাইয়ে দেয় , আমি মিতুর পিছনে বসে তার ঘাড়ের উপর দিয়ে ঝুকে আমার আম্মুটাকে দেখি , আমাদের ইচ্ছা’কে দেখি...
.
.
.
“ ও স্যার...কই হারায়া গেলেন ? এইবার খেয়ে নেন । দেরী হয়ে যাবে তো...” কানের কাছে মিতু’র তাগাদা শুনে ফোন রাখি । আজ আর অফিস করবোনা , ছুটি নিয়ে চলে যাবো । তারপর বিকেলে বাবাই আর আম্মু মিলে ইচ্ছা’কে নিয়ে সারপ্রাইজ ভ্রমণে বেরবো...